এইডস আক্রান্ত এক তরুণের কথা

অনলাইন ডেস্ক- পিঠে হাত রেখে ডাক্তার যখন বললেন, চিন্তা করো না ইয়ংম্যান। তুমি আরো আশি বছর বাঁচবে। বিশ্বাস হয়নি তরুণের। ডাক্তার মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। এটি মরণব্যাধি ভাইরাস। আক্রান্ত হলে মানুষ বাঁচে না। তখন শুধু ভাবছিলেন, তিনি শিগগিরই মারা যাবেন। তার আগে ঘটবে অনেক ঘটনা।

বাসা থেকে বের করে দেয়া হবে তাকে। মা-বাবা, বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে দূরে ঠেলে দেবে। কেউ আশ্রয় দেবে না। ভাবছিলেন আর পুরো শরীর কাঁপছিলো। কথা আটকে যাচ্ছিলো। ঘাম ঝরছিলো। ডাক্তার সাহস দিচ্ছিলেন। তরুণের পিঠে হাত রাখতেই তার বুকে জমাট কষ্টের বরফগুলো গলতে শুরু করে। ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে তরুণটি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্নার শব্দ শুনে পাশের কয়েক জন এগিয়ে যান।

এটি ২০১৬ সালের কথা। সেদিনই প্রথম জানতে পারেন তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। রাজধানীর ঢাকার বাসিন্দা এই তরুণের নাম অনিক। তখন তিনি দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। বয়স ২০ বছর। এই বয়সেই এক অন্যরকম যুদ্ধে নামতে হয় তাকে। বাবা ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। তাদের দুই সন্তান। এক পুত্র অনিক। সিদ্ধান্ত নেন বিষয়টি কোনোভাবেই কাউকে জানতে দেবেন না। 

অনিক জানান, চিকিৎসক তাকে মানসিক শক্তি দেন। সাহস যোগান। কিন্তু শুরুতে ওই প্রতিষ্ঠানেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। অসুস্থ হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানে যান তিনি। এ বিষয়ে অনিক জানান, অসুস্থ বোধ করছিলেন। ঘাড়ের দু’দিক ফুলে গেছে। প্রতি রাতেই জ্বর আসে। ডায়রিয়া হচ্ছে। ভীষণ ক্লান্তি লাগে। ওষুধ সেবন করছেন কিন্তু সুস্থ হচ্ছেন না। তখনই সন্দেহটা হয়। একাদশ শ্রেণিতে ‘অপরাহ্ণের গল্প’ পড়েছেন, তখন থেকেই এইচআইবি সম্পর্কে একটু আধটু ধারণা তার। এরমধ্যেই একটি এফএম রেডিওতে এইডস সংক্রান্ত একটি অনুষ্ঠান শুনেন তিনি। সেখান থেকে ফোন নম্বর পেয়ে যোগাযোগ করে ছুটে যান মোহাম্মদপুরে।

কথা হয় ওই প্রতিষ্ঠানের কাউন্সিলরের সঙ্গে। সুদর্শনা তরুণী মুখোমুখি বসে জানতে চান, কেন টেস্ট করাতে চাচ্ছেন, তিনি অনিরাপদ যৌনসম্পর্ক করেন কি-না? অনিক মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। তরুণী জানতে চান, যৌনপল্লীতে, হোটেলে যৌনকর্মীদের কাছে যেতেন কি-না। অনিক বলেন, না। তরুণী আবার জানতে চান, তাহলে কি গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে? অনিক না- সূচক মাথা নাড়ান। তরুণীর চোখে-মুখে বিস্ময়। তাহলে কার সঙ্গে ফিজিক্যাল সম্পর্ক করতেন?

অনিক মাথা নিচু করে জানান, তিনি হোমোসেক্স করতেন। তরুণী হতভম্ব হয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটি দূরে সরিয়ে নেন। তার চোখে কোনো সহানুভূতি নেই। সেদিন রক্ত পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে যান। কথা ছিল রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট এলে ফোনে তাকে জানানো হবে। তৃতীয় দিন ফোনে ডাকা হয় তাকে। অনিক উপস্থিত হন সেই অফিসে। এবার সেই তরুণী তাকে ডেকে নিয়ে সাহস দেন। তারপরই জানান, তিনি এইচআইবি আক্রান্ত। বুঝানোর চেষ্টা করেন। এটি একটি অসুখ ছাড়া কিছুই না। নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করলে নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সংসার, কাজ সবই করা যাবে। দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যাবে। 

তারপরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তারের কাছে। দ্রুত সিডি ফোর পরীক্ষা করানো হয়। চিকিৎসকরা জানান, এটি রক্তের শ্বেতকণিকার একটি উপাদান। প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে সাধারণত ৯০০ থেকে ১২০০ সিডি ফোর থাকে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে সিডি ফোর উপাদান কমতে থাকে এবং সেই সঙ্গে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। রক্তে সিডি  ফোরের পরিমাণ ২০০-এর নিচে নেমে  গেলে তাকে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি দিতে হয়। পরীক্ষায় জানা যায়, অনিকের সিডি ফোর ৩২০। তারপর শুরু হয় চিকিৎসা। একটা যুদ্ধ।

অসচেতনতার কারণেই তিনি এইচআইভি আক্রান্ত হন বলে তার ধারণা। শুরুতে আশার আলো সোসাইটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন অনিক। এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটিতে। দুটি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা তাকে সেবা দিয়ে আশার আলো দেখিয়েছেন। অনিক জানান, এখন তার সিডি ফোর ৯০০। সুস্থ মানুষের মতোই। কিন্তু তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী কেউ জানেন না তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। অনিক বলেন, জানাজানি হলে আমি এই সমাজে চলতে পারবো না। এমনকি নিজের পরিবারেও থাকতে পারবো না। এইচআইভি আক্রান্তদের নিয়ে তাদের অনেক ভুল ধারণা।  

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের এই ছাত্র বলেন, গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করবো। লিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করবো। আর কেউ যেন তার মতো এইচআইভি আক্রান্ত না হয়। একইভাবে মানুষ যেন সচেতন হয়। এইচআইভি বা এইডস ছোঁয়াচে না, আক্রান্তদের দূরে ঠেলে না দিয়ে সেবা দিতে হবে। অনিক তেমনটিই করতে চান। মানুষের সেবা করাই তার উদ্দেশ্য। 
অনিকের মতো অনেকেই সামাজিকতার কারণে গোপনে এইডসের ভাইরাস এইচআইভি’র সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরে দেশে ১ হাজার ৭শ’ জন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। দেশে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষ আছে প্রায় ১৩ হাজারেরও বেশি। ১৯৮৯ সালে দেশে প্রথম এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছে ১ হাজার ১শ’ জন।